শিফাত মাহমুদ ফাহিম, বিশেষ প্রতিনিধি: শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মহান স্বাধীনতা ৫৩ পেরিয়ে ৫৪ তে। মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে লাখো শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুকও বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জাতীয় স্মৃতিসৌধের পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও ভুটানের রাজা। এসময় ভুটানের রাজা ও তার স্ত্রী রানী জেৎসুন পেমা পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন। পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে দলটির শীর্ষ নেতাদের নিয়ে আবারও জাতীয় স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) ভোর ৫টা ৫৬ মিনিটে স্মৃতিসৌধের বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দাঁড়িয়ে কিছু সময় নীরবতা পালন করেন তারা। এসময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে এবং সশস্ত্র বাহিনীর সুসজ্জিত একটি চৌকস দল তাদের গার্ড অব অনার প্রদান করে।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং ভুটানের রাজার শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতারা। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জাতীয় স্মৃতিসৌধ ত্যাগ করলে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সর্বস্তরের মানুষের জন্য জাতীয় স্মৃতিসৌধের মূল ফটক খুলে করে দেয়া হয়।
সারিবদ্ধভাবে ফুল নিয়ে অপেক্ষমান হাজারো জনতা পর্যায়ক্রমে শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ফুলে ফুলে ভরে যায় শহীদ বেদি আর জনসমুদ্রে পরিণত হয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে এদিন জাতীয় স্মৃতিসৌধে হাজারো মানুষের ঢল নামে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও নানা শ্রেনী পেশার মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় করেন।
আশুলিয়ার শ্রীপুর থেকে ছোট্ট শিশুকে কাঁধে নিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন শফিকুল ইসলাম তিনি বলেন, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি তাদের স্মরণ করতেই স্মৃতিসৌধে এসেছি। মনিকা নামে একজন গৃহিনী আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান নামে দুই ছেলেকে নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন জাতীয় স্মৃতিসৌধে,এসময় মনিকা বলেন, দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি মজান স্বাধীনতা। যাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই মহান স্বাধীনতা তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মহান স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে সন্তানদের পরিচিত করাতে এখানে এসেছি।
স্বাধীনতার বীর সেনানিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, স্বাধীনতা ঘোষণার পাঠক কখনো ঘোষক হতে পারে না। আবুল কাশেম, এম এ হান্নানসহ অনেকেই যেমন স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছেন তেমনি জেনারেল জিয়াও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ঘোষক কে? এ বিতর্কের অবসান তখনই হবে যখন আমরা সত্যের অনুসন্ধান করতে যাব। সেটা হচ্ছে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার ম্যান্ডেট এই অঞ্চলের জনগণের পক্ষ থেকে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই পেয়েছিল। আর কারো কোনো বৈধ অধিকার নেই স্বাধীনতার ঘোষক হওয়ার। তারপরও আমাদের দেশের স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্ক হয়। এত বছর পরও সেই একই বিতর্ক চলছে। আমাদের বক্তব্য, ঘোষণার পাঠক ঘোষক হতে পারে না।
অন্যদিকে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান দাবি করেছেন ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য বিরোধী দলের বিরুদ্ধে এক লাখ মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপির ৫০ লাখ নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে।
ড. আব্দুল মঈন খান আরও বলেন, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমাদের বলতে হচ্ছে, যে উদ্দেশ্যে এবং আদর্শ নিয়ে এই দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, যে আদর্শের জন্য তার নাম ছিল গণতন্ত্র। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। আজকে ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের একটিই প্রশ্ন সেই গণতন্ত্র কোথায় গেলো, সেই দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি কোথায় গেল?
তিনি বলেন, একটি সরকার এ দেশে এসেছে, সে সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তারা মুখে বলে গণতন্ত্র, বাস্তবে করছে একদলীয় শাসন। তারা এবার করেছে বাকশাল-২। এটা আমার কথা নয়, এটা বিশ্ববাসীর কথা। আজকে আপনারা দেখেছেন কিভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে লক্ষ হাজার কোটি টাকা এ দেশ থেকে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। মেগা উন্নয়নের নামে কিভাবে মেগা দুর্নীতি হয়েছে।
মঈন খান আরো বলেন, ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য যারা বিরোধী দল তাদের বিরুদ্ধে এক লাখ মামলা দেওয়া হয়েছে। তাদের ৫০ লাখ নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। মিথ্যা অভিযোগে তাদের আসামি বানানো হয়েছে। এ দেশে যদি মানুষের গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ না থাকে, তাহলে আজকে যারা কবরে শায়িত মুক্তিযোদ্ধা, তাদেরকে প্রশ্ন, কেনো তারা এ দেশটি স্বাধীন করেছিলেন। সেই প্রশ্নের উত্তর আওয়ামী লীগ সরকারকে দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। এটা আজকে অত্যন্ত স্পষ্ট, যখন সেই ২৫ মার্চের কালরাতে পাক হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের ওপরে হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়েছিল। সেদিন আজকের আওয়ামী লীগ, যারা আজকে নিজেদের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে দাবি করে, যারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তি বলে দাবি করে, তারা সেদিন পলায়নপর ভূমিকা নিয়েছিল।
আমরা তো স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। যে যেটা বলতে চায় বলবে। আওয়ামী লীগের কেউ কিছু বললে আমরা তার টুঁটি চেপে ধরি না। কাজে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ গণতন্ত্রে থাকবে। কিন্তু ইতিহাসের যে সত্য, সেটি ইতিহাসই নির্ধারিত করে। আজকে বলে দিতে হবে না, কারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করে এ দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বাধীনতা অর্জন করেছিল।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেছেন, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ ভাবে সেই সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তিকে পরাজিত করেছিল। স্বাধীনতার পরে শাসক শ্রেণি, তাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার জন্য এসব সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাত করেছে। তাদের প্রত্যক্ষ আশ্রয় এবং প্রশ্রয়ে এই সাম্প্রদায়িক শক্তি এখনও বাংলার মাটিতে রয়েছে। আমরা মনে করি, ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক শক্তির কারণেই সাম্প্রদায়িক শক্তি রয়েছে।
জাতীয় সমাজ তান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সহসভাপতি তানিয়া রব বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রাপ্তি থেকে জনসাধারণ এখনও অনেক দূরে রয়েছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারিনি। কেন পারিনি, সেটা আমাদের বড় দুঃখ রয়ে গেল, সেটা যেমন সত্য, শাসক দলের একটা ধারনা তারা সবটাই করছে।
’কিন্তু ৫৪ বছর পরে আমরা যদি ৫০ বছর বয়সের মুক্তিযোদ্ধা পাই, তাহলে এই ক্ষেত্রে যে গাফিলতিটা, এই ক্ষেত্রে যে একটা স্বেচ্ছাচারী মনোভাব। তার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন বড় একটা ফারাকের মধ্যে থাকে বলে যোগ করেন তিনি।
যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ বলেছেন, শেখ হাসিনা যেরকম নিষ্ঠার সাথে বর্তমান বাংলাদেশকে লালন করছে, সেখান থেকে যুব সমাজ শিক্ষা নিতে পারে। যুব সমাজ ও তরুণ সমাজের কাছে প্রত্যাশা বঙ্গবন্ধু যে প্রতিবাদী ও সাহসী ভূমিকা রেখেছেন, একাত্তরের গণহত্যার পরে বিশেষ করে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করা, যেখানে এক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা ঘোষণা করা খুবই সাহসী ও প্রতিবাদী যে পদক্ষেপ সেই পদক্ষেপ দ্বারা নতুন প্রজন্ম সামনের দিকে এগিয়ে যাবে ও ভূমিকা রাখবে।
পরশ আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিটা আমরা এখনও পাই নাই। এটা এই প্রজন্মের সময়ের দাবি, এটা পাওয়ার জন্য আমাদের সবাইকে সচেতন এবং সোচ্চার হতে হবে।
Leave a Reply