হুমায়ুন কবির, সাভার:
ঈদের আগমুহূর্তে তীব্র দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন সাভার চামড়া শিল্প নগরীর ট্যানারি মালিকরা। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়া, চীনের বায়ারদের দরপতনের চাপ এবং রফতানি স্থবিরতার ত্রিমুখী সংকটে বিপর্যস্ত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিমুখী এই খাত।
চামড়া খাত সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনার প্রভাব পড়েছে সরাসরি এ খাতে। চীনা আমদানিকারকেরা যুক্তরাষ্ট্র-চীন শুল্ক যুদ্ধের অজুহাতে ১০–১৫ শতাংশ মূল্য হ্রাসের দাবি জানাচ্ছেন। অথচ ঈদ সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া সংগ্রহে ট্যানারি মালিকদের প্রয়োজন নগদ অর্থ। এই মুহূর্তে ১০০–১২০টি কনটেইনারে আটকে আছে প্রক্রিয়াজাত চামড়া—ক্রেতার ছাড়পত্র না মেলায় এসব পণ্য রফতানি করা যাচ্ছে না।

চীনের দখলে বাজার, বিকল্প নেই
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য এবং এবিএস ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমাম হোসাইন বলেন, “গত বছরের সংগৃহীত পশুর চামড়ার ২৫–৩০ শতাংশ এখনও অবিক্রীত। চীনা বায়াররা কম দামে পণ্য নিতে চায়। আমরা উৎপাদন খরচই তুলতে পারছি না। এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় বাজার নির্ভর হয়ে পড়েছে চীনের ওপর।”
তিনি জানান, শ্রমিকের মজুরি, লবণ, ব্যাংক সুদ—সবকিছুর খরচ বেড়েছে। “৭৪ কেজির লবণের বস্তা এখন ১ হাজার টাকা, ব্যাংক সুদ বেড়ে ১৬ শতাংশ হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে চামড়া কিনে প্রক্রিয়াজাত করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
রফতানির ধারাবাহিক পতন
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে চামড়া রফতানি ৮.২৪ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১০৭.৬১ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছর এ সময় আয় হয়েছিল ১১৭.২৭ মিলিয়ন ডলার।
বিসিক চামড়া শিল্প নগরীর এক প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে তারা ৫৪ লাখ বর্গফুট চামড়া রফতানি করে আয় করেছে ৩৯.৩৭ কোটি টাকা—যা আগের বছরের তুলনায় ৩৮.১২ শতাংশ কম। প্রতি স্কয়ার ফুটে গড় দামও কমেছে ১২.৪৪ শতাংশ।

“সরকার চাইলে সব সম্ভব”
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য এবং এবিএস ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমাম হোসাইন বলেন, ফুল সেক্টরের জন্য আমাদের আড়াইশো কোটি টাকার নগদ সহায়তার ক্লেইম ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকে এই প্রণদোনার ক্লেইম ছিল। সরকার বলেছিলেন এটি ছার করে দিবেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি এখনো ছার করেনি।
এমনকি আসছে কোরবানি ঈদে চামড়া কেনার জন্য ব্যাংক থেকেও আমরা কোন লোন সুবিধা পাচ্ছিনা। “হাজারীবাগে যেই চামড়া ১.৪০ ডলারে বিক্রি করতাম, এখন তা যাচ্ছে ০.৪৫ ডলারে। ৮ লাখ স্কয়ার ফুট চামড়া শিপমেন্টের অপেক্ষায় পড়ে আছে। চীনা বায়াররা শুল্কের বাড়তি চাপ আমদানিকারকদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।”
তিনি বলেন, “এই সেক্টরের একমাত্র উত্তরণের পথ এলডব্লিউজি সার্টিফিকেশন। সরকার যদি সিইটিপি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমাধান করে, তাহলে আমরা প্রস্তুত আছি।”
মূল্য বৃদ্ধি নয়, দাবি করছে বিসিক
বিসিক লবণ সেলের প্রধান সরোয়ার হোসেন অবশ্য বলেছেন, “লবণের দাম বেড়েছে—এ অভিযোগ পুরোপুরি সত্য নয়। বরং কক্সবাজারে মনপ্রতি দাম কমে এসেছে ৩০০ টাকা থেকে ২৭০ টাকায়। মিলে ১৩ টাকা কেজি দরে সরবরাহ করছি।”
সিইটিপি উন্নয়নে বিদেশি সহায়তা
ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানির এমডি গোলাম শাহনেওয়াজ বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ১৫ মাস মেয়াদি একটি প্রকল্পে সিইটিপি’র সক্ষমতা যাচাই ও মানোন্নয়ন শুরু হয়েছে মার্চ থেকে।”
তিনি আরও জানান, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ১০ কোটি টাকার একটি সেইফ ল্যান্ডফিল নির্মাণের উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। চামড়া খাতের বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ অর্জনের জন্য মোট ১ হাজার ৭১০ নম্বরের মধ্যে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ১৫০ নম্বর নির্ধারিত রয়েছে,সেখানে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে জানান তিনি।
সংকটের ছায়া দীর্ঘতর
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান আশিকুর রহমান বলেন, “গত বছর যেই চামড়া ৭২ সেন্টে বিক্রি করেছি, এ বছর তা শুরু হয়েছে ৪৫ সেন্ট থেকে। দেশের ফুটওয়্যার মার্কেটের ৯০ শতাংশই আমদানিনির্ভর—আমাদের দখল কম।”
চামড়া খাতের নেতৃস্থানীয়রা বলছেন, সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে সামনে আরও খারাপ সময় অপেক্ষা করছে।