হুমায়ুন কবির :
নিখোঁজের দুই মাস পর আশুলিয়ার মনোদিয়া চৌরাপাড়ার একটি বসত বাড়ির আঙ্গিনা থেকে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক রেহেনা পারভিন (৩৭) নামের এক নারীর অর্ধগলিত মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। অপহরণ মামলার প্রেক্ষিতে রহস্য উদঘাটন করতে পুলিশের সময় লেগেছে দুই মাস।
অপহরণ করে হত্যার পর মরদেহ পুতে রাখা হয় একটি বসতবাড়ির আঙিনায়।
এঘটনায় ননদসহ দুই জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত নিহতের স্বামী আওলাদ হোসেন অস্ট্রেলিয়ায় পালিয়ে যাওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
বৃহস্পতিবার (১২ই সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা সাতটার দিকে আশুলিয়ার মনোদিয়া চৌরাপাড়ার একটি বসত বাড়ির আঙ্গিনা থেকে আসামী পাপিয়া আক্তারের নির্মাণাধীন বাড়ির সামনে থেকে লাশটি উদ্ধার করে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার দোহার সার্কেল আশরাফুল আলমের নেতৃত্বে পুলিশের একটি চৌকশ দল। অপহরণ মামলাটির রহস্য উদঘাটন ও মরদেহ উদ্ধারে প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে স্মৃতিসৌধ পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই অলক কুমার দে পিপিএম। এর আগে রেহেনা পারভীনের মা ৩ই জুলাই নবাবগঞ্জ থানায় ৪জনের নাম উল্লেখ একটি অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেন।
নিহত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত নারী ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার পাতিল গ্রামের লেহাজ উদ্দিনের মেয়ে। সে স্বামী আওলাদ হোসেন ও পাঁচ ছেলে মেয়ে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করতেন।
অভিযুক্তরা হলেন- নিহতের স্বামী আওলাদ হোসেন (৪৭), সে একই গ্রামের মৃত আঃ মান্নানের ছেলে। একই থানার ছোট রাজপাড়া গ্রামের মৃত জহুর উদ্দিনের ছেলে আমজাদ হোসেন (৬৪),সে নিহতের চাচা শ্বশুর। নিহতের ননদ পাপিয়া আক্তার( ৩৬) । অপর একজন মাকসুদা। এদের মধ্যে আমজাদ হোসেন ও পাপিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এজাহার থেকে জানা যায়, রেহেনা পারভিন ২ঌই জুন তার ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশে আসে। এরপরের দিন সে তার বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি চলে যায়। গত ০৩ ই জুলাই বিকাল ০৫ টার দিকে নিহতের মাকে ফোন করে বলে তাকে মারধর করা হয়েছে। তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল নিয়ে গেছে। এর পর থেকে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না তার। পরে অস্ট্রেলিয়ান এম্বাসি রেহেনার বেগমের পরিবারকে অবগত করেন। এর মধ্যেই নিহত রেহেনার স্বামী আওলাদ হোসেন ১৩ই জুলাই অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে বলে জানতে পারে পরিবার। পরে তারা ৪জনের নাম উল্লেখ করে নারী ও শিশু নির্যাতন ও অপহরণ মামলা দায়ের করেন। ।
নিহতের মা আইরিন আক্তার বলেন, আমার মেয়েকে অনেক কষ্টে লেখাপড়া করিয়েছি। পরে তাকে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠাই। সেখানে সে নাগরিকত্ব পায়। পরে আওলাদ হোসেন এক পর্যায়ে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে করে আমার মেয়েকে। অস্ট্রেলিয়ায় থাকাকালীন সময়ে আমার মেয়ে অনেক সম্পদ হয়। আমার মেয়ে নিজ নামে সব সম্পদ করে। সেই সম্পদের জন্য আওলাদ, আওলাদের বোন, ভাইসহ পুরো পরিবার আমার মেয়েকে কৌশলে হত্যার পর লাশ গুম করে। হত্যার দুই মাস পর আজ পুলিশ আমার মেয়ের লাশ উদ্ধার করে। আমি খুনিদের সবার ফাঁসি চাই।
নিহতের ভাই রবিন কালবেলাকে বলেন, আমার বোনকে পরিকল্পিতভাবে খুন করে লাশ ঘুম করেছে তার স্বামী, ননদসহ পুরো পরিবার। ঘটনার দুই মাস পরে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। খুনিদের বিচার চেয়ে অঝোরে কাঁদেন তিনি। এবং হত্যার সাথে জড়িত সকলের ফাঁসি দাবি করেন।
ঘটনার পেছনের ঘটনা পর্যালোচনা এবং কয়েকদিনের টানা ইনভেস্টিগেশন শেষে রহস্য উদঘাটনে বিশেষ ভূমিকা রাখা আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক স্মৃতিসৌধ ফারির ইনচার্জ অলক কুমার দে পিপিএম কালবেলাকে বলেন, গত ৩ জুলাই নবাবগঞ্জ থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি হয়। ভুক্তভোগী রেহেনা পারভিনের একটি বাড়ি ছিল আশুলিয়ার স্বরলতা হাউজিং। সেখানে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য আমাকে মৌখিক নির্দেশনা দেন ঢাকা জেলার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (দোহার সার্কেল) মো: আশরাফুল আলম। পরে আমি রেহেনাকে উদ্ধারে তদন্ত শুরু করি। সেই তদন্তে আসামি পাপিয়া ও আমজাদকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করি। পরে নিখোঁজ ডায়েরির তদন্তকারী কর্মকর্তা নূর খানকে সাথে নিয়ে আসামিদের গ্রেপ্তার করি।
মোঃ আশরাফুল আলম( সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার দোহার সার্কেল) বলেন, জুনের শেষের দিকে রেহানা পারভীন দেশে আসে। ঠিক তার কয়েকদিন পরে তার স্বামী আওলাদ হোসেন অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে আসেন । তারা দুজনেই অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। তারা ২০ বছর ধরে সংসার করছেন অস্ট্রেলিয়াতেই । তাদের পাঁচজন সন্তান রয়েছে । তবে তাদের বেশিরভাগ সম্পত্তি বাংলাদেশে। সেগুলো দেখতে রেহেনা বেগম মাঝে মধ্যেই দেশে আসে। তবে সেই সম্পত্তি অধিকাংশ রেহেনা বেগমের নামে। এর জের ধরে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রেহানে বেগমকে তুলে নিয়ে হত্যার পর আশুলিয়ার পাথালিয়া ইউনিয়নের মনোদিয়া চৌরাপাড়া গ্রামের নির্মাণাধীন বাড়ির উঠানে মাটি খুঁড়ে পুতে রাখে।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু সে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। তাই অ্যাম্বাসিতে ফিরে যাওয়ার সম্ভাব্য সময় দিয়ে আসতে হয়। কিন্ত রেহেনা ফিরে না যাওয়ায় অ্যাম্বাসি থেকে তার পরিবারকে বিষয়টি জানায়। এরপরেও রেহেনা ও তার স্বামী আওলাদ হোসেনকে খোঁজে পাওয়া যায়নি। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে জানতে পারে গত ১৩ই জুলাই আওলাদ হোসেন অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথমে একটি সাধারণ ডায়েরি ও পরবর্তীতে একটি মামলা দায়ের করেন। দেশের ক্রান্তিকালে তদন্ত একটু দেরি হলেও আমরা দুজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই। তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে আজকে তার গলিত মৃতদেহ উদ্ধার করি।
Leave a Reply