নিজস্ব প্রতিবেদক : মিরপুরের সনি সিনেমা হল কে না চেনে? কিন্তু এর জায়গা নিয়ে অভিনব জালিয়াতির কথা অনেকেই জানেন না। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে থলের বিড়াল! রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বর সেকশনের সনি সিনেমা হল নামে পরিচিত জায়গাটি ১৯৮০ সালে সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ পান জনৈক মোহাম্মদ হোসেন। ‘সনি ব্রিকস’ নামে বরাদ্দ পাওয়া ৩০ কাঠা আয়তনের শিল্প-প্লটটির মূল্য বাবদ অর্থ পরিশোধ করেননি তিনি সরকারি কোষাগারে। পরে ৩০ কাঠার সঙ্গে আরও ১৫ কাঠা (ফাঁকা জায়গা) যুক্ত করে প্লটের আয়তন ৪৫ কাঠায় উন্নীত করেন তিনি।
৪৫ কাঠার শিল্প-প্লট তিনি নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করছেন। বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য প্লটের শ্রেণি পরিবর্তন করতে হলে সরকারের কোষাগারে ৪৫ কোটি টাকা রূপান্তর ফি আসার কথা। কিন্তু তা আসেনি। ২০০ কোটি টাকার প্লটটির মূল নথি ও রেজিস্টার বই গায়েব করে ফটোকপি দিয়ে নতুন নথি খোলা হয়েছে। তড়িঘড়ি করে হস্তান্তর করতে গেলে বেঁকে বসেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সরকারি প্লটের বরাদ্দ পেলে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দুই-তিন জায়গায় জমা থাকে। কিন্তু এ প্লটের বিষয়ে শুধু কয়েকটি ফটোকপি দিয়ে একটি ফাইল খোলা হয়েছে। বরাদ্দপত্র, কিস্তি-পরিশোধের রসিদ, দায়মুক্তি, ডিসিআর, বাস্তব-দখল, হেবা অনুমতি প্রভৃতি দালিলিক প্রমাণের কোনো স্মারক নেই। এসব কাগজপত্র গৃহায়নের তৎকালীন কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্লটের মালিক দাবিদার মোহাম্মদ হোসেন তৈরি করেছেন। এ ফাইলসংক্রান্ত কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। মালিকানাবিষয়ক উপাখ্যান : ১৯৮০ সালের ৩০ এপ্রিল পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি কমিশনার সেটেলমেন্ট অফিস থেকে ২৪০০ বর্গগজ অর্থাৎ ৩০ কাঠা জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। মূল্য ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এটি মিরপুর ২ নম্বর সেকশনের মেইন রোড-২-এর ১ নম্বর শিল্প-প্লট। প্লটটি মিরপুর গৃহসংস্থানের উপবিভাগ-২-এর দপ্তর থেকে পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮১ সালের ২৮ মে সনি ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের মালিক মোহাম্মদ হোসেনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর মোহাম্মদ হোসেনের নামে একই বছরের ২৮ মে ইজারাচুক্তি-রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়। পরের মাসের অর্থাৎ ২৩ জুন শিল্প-প্লটটি বাণিজ্যিক ব্যবহারের (সিনেমা হল ও মার্কেট নির্মাণ) জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর ৩০ কাঠা জমির ওপর ইমারত নির্মাণের জন্য রাজউকের অনুমতি নেওয়া হয়। একই বছরে ওই প্লটের ১৯২০ বর্গগজ জমি মোহাম্মদ হোসেনের স্ত্রী আঞ্জুমান হোসেন, মেয়ে শাহানাজ হোসেন, মুনমুন হোসেন ও ছেলে সাজ্জাদ হোসেনের নামে হেবা ঘোষণাপত্রের অনুমতি দেওয়া হয়। হেবা ঘোষণাপত্রের অনুমতি পাওয়ার ২৫ বছর পর ২০২০ সালের ১৩ জুলাই মোহাম্মদ হোসেন উত্তরাধিকারীদের নামে ১৯২০ বর্গগজ জমি রেজিস্ট্রি করে দেন। বর্তমানে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের নামে সে জমি নামজারির জন্য আবেদন করেছেন। মূল নথি গায়েব হয়ে যাওয়ায় এ জমি নামজারির অনুমোদন পাচ্ছেন না তিনি।
গৃহায়নের কর্মকর্তারা বলছেন, মোহাম্মদ হোসেন নিজে যেসব ফটোকপি দিয়ে নথি খুলে মালিকানা দাবি করছেন; সেগুলোতে তিনি ১৯৯৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর হেবার অনুমতি পেয়েছেন বলে দাবি করেন। আবার ২৩ বছর পর ২০১৮ সালের ২৪ জুন হেবা অনুমোদনের জন্য আবেদন করেন। একইভাবে ১৯৮১ সালের ২৩ জুন শিল্প-প্লটটিতে বাণিজ্যিক ব্যবহারের (সিনেমা হল ও মার্কেট নির্মাণের) অনুমতি দেওয়া হয়েছে দাবি করেন। ২০১৮ সালের একটি আবেদনে তিনি প্লটের ধরন হিসেবে ‘শিল্প-প্লট’ উল্লেখ করেন। নথিটি পর্যালোচনা করলে নানা ধরনের অসংগতি উঠে আসবে। কাগজপত্র ‘এক্সপার্ট’ দিয়ে যাচাই করা হলে আসল ঘটনা জানা যাবে।
১৯৮০ সালে ৩০ কাঠা বরাদ্দ পেলেও এখন প্লটটি ৪৫ কাঠার। ১৯৮৫ সালের ৩ ডিসেম্বর আরও ১২১১ বর্গগজ অর্থাৎ ১৫ কাঠা জমি বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। যার মূল্য ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৪ হাজার ৩৫৭ টাকা। আশির দশকে এত বড় জমি বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ ছিল কি না তা সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। তবে প্লটের দাবিদারের পক্ষের দাখিল করা ফটোকপিতে দেখা যায়, মোহাম্মদ হোসেন বর্ধিত জমির বিপরীতে তিন কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করেছেন।
২০১৮ সালের ২৪ জুন হেবা অনুমোদনের জন্য আবেদন করেন মোহাম্মদ হোসেন। সেখানে তিনি প্লটের ধরন হিসেবে ‘শিল্প-প্লট’ উল্লেখ করেন। গৃহায়নের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য নীতিমালা রয়েছে। উল্লিখিত প্লটটির প্রতি কাঠার মূল্য ৫০ লাখ টাকা ধরে তা রূপান্তর করে বাণিজ্যিক করতে হলে দ্বিগুণ হারে ফি অর্থাৎ ১ কোটি টাকা দিতে হবে। ৪৫ কাঠা জমির জন্য রূপান্তর ফি ৪৫ কোটি টাকা সরকারকে পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু অর্থ পরিশোধের নথিপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। বর্তমানে সেখানে নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা জামানতসহ প্রতি মাসে ভাড়া হিসেবে আদায় করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। প্লটটির একাংশে বছরখানেক আগে স্থাপন করা হয়েছে স্টার সিনেপ্লেক্স। সেখান থেকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচ্ছেন মোহাম্মদ হোসেন।
যেভাবে মূল নথি-রেজিস্টার গায়েব হলো : কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সনি ব্রিকসের নামে নিয়মমাফিক প্লট বরাদ্দ হওয়ার পর মালিক ও হাউজিংসংশ্লিষ্টরা মিলে মূল নথি গায়েব করে ফেলে। এরপর ফটোকপি দিয়ে একটি ফাইল খুলে রাখা হয়। এ কাজের সঙ্গে আলোচ্য প্লটের দেখভাল করেন এমন একজন প্রভাবশালী ডিলিং অ্যাসিস্ট্যান্ড জড়িত ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, আইন শাখা ও তৎকালীন উপকমিশনার (পত্তন)-এর ব্যক্তিগত সহকারী মো. নূরুজ্জামান ও গৃহায়নের ভূমিসম্পত্তি বিভাগের নিম্নমান সহকারী মো. শামসুল হক ও উচ্চমান সহকারী মো. আওলাদ হোসেনের হাত ধরে নথি গায়েব হয়। নথি গায়েবের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সংশ্লিষ্টরা কোনো প্রতিবেদন দেননি। ফলে অজানাই রয়ে গেল সরকারের প্রায় ২০০ কোটি টাকা মূল্যের এ সম্পত্তির নথি কে বা কারা গায়েব করলো।
সনি ব্রিকসের নামে বরাদ্দ হলেও তা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের বিষয়টি সংস্থার শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরই জানা। প্লটের মালিকানার দলিলপত্র নিয়েও কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয় না। মিরপুর এলাকার গৃহায়নের জমির দায়িত্বে থাকা ভূমি শাখা, নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার বিষয়টি দেখভাল করার কথা। অদৃশ্য কারণে তারা জেনেও না জানার ভান করেন।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) চেয়ারম্যান মো. দেলওয়ার হায়দার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গৃহায়নের জমি অন্যায়ভাবে দখল বা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। সনি ব্রিকস বা সনি সিনেমা হলের ঘটনাটি আমার জানা ছিল না। এখন খোঁজখবর নিয়ে যদি কোনো নিয়মের ব্যত্যয় পাওয়া যায় তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গৃহায়নের নির্বাহী প্রকৌশলী (ঢাকা ডিভিশন-১) জোয়ার্দার তাবেদুন নবী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্লটের মালিকানা দাবিদার মোহাম্মদ হোসেনের পক্ষ থেকে দাপ্তরিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে একটি আবেদন করা হয়েছে। আমরা নথিতে পর্যাপ্ত দালিলিক প্রমাণ পাইনি। যা পেয়েছি তার সবই ফটোকপি। এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে তা প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাছে আছে।’
সনি ব্রিকস বা সনি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের মালিক মোহাম্মদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি দুটি ভাগে প্লট বরাদ্দ পেয়েছি। নিয়ম মেনে সব কাজ শেষ করেছি। নামজারির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ফাইল হারানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের লোকজন বলতে পারবেন।’
Leave a Reply